কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের অলিগলি থেকে এই শহুরে কিংবদন্তির জন্ম। যে সমস্ত প্রকাশকরা লেখকদের সাথে প্রতারণা করে থাকেন তাদের তাড়া করে বেড়ায় এই আদিম আতঙ্ক। গল্পটা একটা অলৌকিক ওয়েবসাইটকে কেন্দ্র করে। শোনা যায় যে প্রতারক প্রকাশকেরা যখন তাদের মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তখন আচমকাই এই ওয়েবসাইট টা খুলে যায়।
গল্পের উৎস: কলকাতা, ভারত
0
ঘটনাটা হয়েছিল ঠিক আগের বছরে।
অনির্বাণের ফোন ঘন ঘন বেজে চলেছে টেবিলের ওপর। টেবিলের পাশে হোম সেন্টার থেকে আনা দামি লোমশ চেয়ারের উপর গা এলিয়ে সিগারেট খেতে খেতে ফোনটার দিকেই দেখছিল সে। তার এই অভ্যাস বড় পুরনো। রিং হতে থাকা ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া আর তারপর আবার রিং হওয়া। জিনিসটা বেশ উপভোগ করে অনির্বাণ। যদিও বা ফোনটা কেটে দেওয়া যায়, কিন্তু তাহলে তো যে ফোন করছে সে জেনে যাবে যে অনির্বাণ ইচ্ছা করে কেটেছে। তখন আবার ঘুরিয়ে কল করতে হবে।
তুষারের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। সেই রাত্রে প্রচন্ড পরিমাণে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। কলকাতার রাস্তায় তো সামান্য ব্যাঙের প্রস্রাবে জলে থৈ থৈ করে, সেখানে এরকম দুর্যোগে এক কোমর জল হয়ে গেছিল চারিদিকে।
হাসপাতালের রিসেপশন এর কাছে অস্থিরভাবে ফোন হাতে চলাফেরা করছিল তুষার। “অনির্বানদা, তুমি কোথায়?” সে আবার ফোন করল।
অনির্বাণ ফোনটা তুলল, “হ্যালো, তুষার?”
“দাদা, আমি খুবই বিপদে আছি। টাকাটা এখুনি দরকার। হাসপাতালের লোক অপারেশন করাবো না বলে দিয়েছে টাকা না দিলে।”
একটু ধমকের সুরেই শান্তভাবে অনির্বাণ বলল, “আমি বলেছি না, চিন্তা করো না। আমি ব্যবস্থা করছি। তুমি হাসপাতালে থাকো।”
“কিন্তু দাদা, কতক্ষণ লাগবে? আমার খুবই টেনশন হচ্ছে,” তুষার বলল।
“তুমি আমার উপর ভরসা রাখো। আমি কিছুক্ষণ পরেই আসছি,” অনির্বাণ আশ্বাস দিল।
ফোনটা কেটে অনির্বাণ ফোনটা সুইচ অফ করে দিল। এই দুর্যোগের রাতে গাড়ি নিয়েও বেরোনো যাবে না। আর বেরোনো গেলে ও সে বেরোত বলে মনে হয় না।
এই ঝড় বৃষ্টি হয়ে ভালোই হয়েছে। কিছু একটা অজুহাত দিয়ে দেবে সে। হালকা কেন হেসে উঠলো অনির্বাণ।
প্রায় কয়েক ঘন্টা হয়ে গেছে।
এই বৃষ্টির সময় কোন গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় না। একবার চেন্নাইতে ওলা কোম্পানি নৌকার ব্যবস্থা করেছিল। এইসব ভাবতে ভাবতে তুষার দ্রুত ছুটছিল জলের মধ্যে দিয়ে।
অনির্বাণদার প্রতি তার অগাধ আস্থা থাকলেও ফোনটা সুইচ অফ দেখে তার টেনশন দ্বিগুণ হয়ে গেল। একে তো রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। কোন অঘটন ঘটলো না তো?
হঠাৎ একটা দশাসই ট্রাক জোরালো হেডলাইট জ্বালিয়ে চোখ ধাধিয়ে ওর পাশ দিয়ে চলে গেল। রাস্তার জলে হালকা ঢেউ উঠল ট্রাকের চাকার ধাক্কায়। রাস্তার বাদামি কালারের নোংরা জল তুষারের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। তুষার বুঝতেই পারল না কখন কী ঘটল। সারা শরীর ভিজে একাকার, রাস্তার জল আর বৃষ্টির ধারা মিলে যেন কোনো পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী হয়ে উঠেছে।
সুতরাং স্বভাবসিদ্ধভাবেই সে ট্রাকটার দিকে পিছন ফিরে কয়েকটা অভিশাপ দিল।
পিছন ফিরে সামনে পা রাখতেই টাল সামলাতে না পেরে সে জলের নিচে তলিয়ে গেল। তুষার দক্ষ সাঁতারু কিন্তু এক মিনিট ধরে হাত পা ঝাপটে দেখলো ওপরের দিকে একটা দেওয়াল। সর্বনাশ, এটা তো ম্যানহোল। চিৎকার করার কোন সুযোগই পায় নি সে।
1
অনির্বানের একটা ছোট্ট প্রকাশনা আছে কলেজ স্ট্রিটে। এই কয়েকদিন আগেই সে ফেসবুক গ্রুপগুলোতে পোস্ট করেছিল যে শারদীয়া উপলক্ষে সে একটা ভূতের গল্পের ছোটখাটো সংকলন বানাতে চলেছে। লেখা জমা দিয়ে মনোনীত হলে তা সে ছাপবে।
আর এখান থেকেই সব ঝামেলা সুত্রপাত। সেই দিন বিকেল বেলায় এক সুন্দর দেখতে যুবতীর কাছ থেকে ফেসবুকে মেসেজ পেয়ে সে খুশি হয়ে উঠেছিল। শুধু একটা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এর ফাইল দিয়েছে। আর কোন হাই হ্যালো নেই। কোন কথাবার্তাও নেই। নামের উপর ক্লিক করে সে প্রোফাইলটা খুলে দেখলো ওটা লক করা আছে। ঘাটাঘাটি না করতে পেরে একটু নিরাশ হয়েই সে মেসেজ করে ফোন নাম্বারটা চাইলো।
সে তো বলেই রেখেছিল, গল্প যদি নির্বাচিত হয় তাহলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হবে। আরো দু’একদিন কেটে গেল। কোন রিপ্লাই এলো না। এই দু সে আরো কয়েকবার প্রোফাইলটা খুলে ঘাটাঘাটি করার চেষ্টা করেছে। ফ্রেন্ড লিস্টে একটা বন্ধু পর্যন্ত নাই এই মেয়েটার। দেখে মনে হল পুরো নতুন তৈরি করা হয়েছে।
ভুয়ো অ্যাকাউন্ট নয় তো ?
এখন সেই মেয়ের ছবিটাও নেই। তার জায়গায় একটা ছোট্ট বাচ্চার ছবি। ছবি বদল করার সময় আছে, গল্প জমা দেবার সময় আছে, গল্প লেখার সময় আছে কিন্তু দু’লাইন জবাব দিতে এত কিসের অহংকার?
সে যাই হোক। তার যায় আসে না।
অনির্বাণের মুখের কোনে হালকা হাসি ফুটে উঠলো। বিগত কয়েক বছরে সে কোন লেখককে পয়সা দিয়েছে বলে তার মনে পড়ছে না। এসব ফেসবুকে লেখা তো এক ধরনের আজকালকার ভাষায় গিমিক। গল্পটা প্রকাশ করতে সে পয়সা নিচ্ছে না লেখকের কাছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার!
আজ সাত দিন হতে চলল। খবরের চ্যানেলে সবাই সাইক্লোন সাইক্লোন বলে চেঁচামেচি করছে। ঝড়টা উঠেছে ও বেশ জোরে। আজ আর দোকান খুলে কোন লাভ নেই। এই ঝড়ের ভয়ে এমনি কোন লোকজন আসবে বলে মনে হয় না। একটা কফি বানিয়ে আরাম করে সোফার মধ্যে ল্যাপটপটা নিয়ে বসতে সে। অনেকগুলো গল্প জমা পড়েছে। সেগুলোকে পড়ে ফেললে কেমন হয়?
কাজটা একটু এগিয়ে থাকবে।
কি জানি মনে করে প্রথমেই সে সেই অজানা তরুণীর দেওয়া গল্পটা খুলে বসলো। বড় অদ্ভুত গল্প।
2
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের অলিগলি থেকে এই শহুরে কিংবদন্তির জন্ম। যে সমস্ত প্রকাশকরা লেখকদের সাথে প্রতারণা করে থাকেন তাদের তাড়া করে বেড়ায় এই আদিম আতঙ্ক। গল্পটা একটা অলৌকিক ওয়েবসাইটকে কেন্দ্র করে। শোনা যায় যে প্রতারক প্রকাশকেরা যখন তাদের মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তখন আচমকাই এই ওয়েবসাইট টা খুলে যায়।
ওয়েবসাইটের লিংক হচ্ছে – dirtyminds.in
এটি কোনও অশ্লীল সাইট নয়! কিন্তু আপনি কি কখনও মানুষের মাথা কাটা হচ্ছে এমন ভিডিও দেখেছেন? আপনি কি কখনও সরাসরি দুর্ঘটনার ভিডিও বা আসল ভূতের ভিডিও দেখেছেন?
যদি আপনি সাইটটি অ্যাক্সেস করতে গিয়ে সার্ভার এরর দেখেন, তাহলে জানবেন যে ওয়েবসাইটটি অফলাইনে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ সময়ই সাইটটি অফলাইনে থাকে!
আজ থেকে কয়েক বছর আগে এখানকারই এক ছাত্র এই ওয়েবসাইট টা তৈরি করেছিল। তারপর কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় গরমের ছুটিতে সে একদিন আসামে কোন একটা গ্রামে যায়। তারপর আর তার কোন খবর পাওয়া যায়নি
যাইহোক, ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেস পেতে তিনটি নিয়ম মেনে চলতে হবে।
- আপনাকে একা থাকতে হবে।
- আপনার বাড়ির সব লাইট বন্ধ করতে হবে।
- আকাশে চাঁদ দেখা যাবে না ঠিক এমন রাতে ঠিক রাত বারোটার সময় ওয়েবসাইট টা খুলতে হবে।
যদি আপনি সবকিছু সঠিকভাবে করেন, তবে আপনি ওয়েবসাইট টা দেখতে পাবেন।
ভিতরে প্রবেশ করার পরে, আপনি একের পর ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়েদের চিৎকাররত মুখের অন্তহীন দৃশ্য দেখতে পাবেন। তাদের মুখ ভয়ে বিকৃত, নিঃশব্দ চিৎকারে জমে আছে। তাদের চোখ নেই, পরিবর্তে দুটি ফাঁকা গর্ত।
এরপর কিংবদন্তীর নিয়ম অনুযায়ী, কিছু বাংলা লাইন স্ক্রিনে ফুটে উঠবে : “ভয়ের এক নতুন ধরনের রূপ দেখতে এই ওয়েবসাইটটা ব্যবহার করুন। এএই ভয় আপনার সমস্ত পাঁচটি ইন্দ্রিয় ব্যবহার করবে। ভুল করে কিছু ক্লিক করবেন না। আপনি একটি বাস্তব ভয়ের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চলেছেন। অভিজ্ঞতায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে ‘গ্রহণ করুন’ বোতামটি ক্লিক করুন।” লেখার নিচে দুটি বোতাম থাকবে, “গ্রহণ করুন” এবং “প্রত্যাখ্যান করুন”।
এই মুহূর্তে, আপনি হয়তো খুবই কৌতূহলী হবেন। ‘গ্রহণ করুন’ বোতামে ক্লিক করার লোভ হতে পারে। কিন্তু তা করবেন না। যদি আপনি এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন, তবে আপনি আপনার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। ‘প্রত্যাখ্যান করুন’ বোতামে ক্লিক করা নিরাপদ।
3
অনির্বাণ অবশ্য নিজেও একজন ওয়েবসাইট ডেভেলপার। ইনস্টাগ্রাম এর রিলে এই ধরনের আজগুবি গল্প সবসময় শুনে থাকলেও, আজ তার বড়ই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। এমনিতেই সে খুব তাড়াতাড়ি ভয় পেয়ে যায়। ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিল সে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ভয়টা কাটানোর জন্যই হয়তো ইউটিউবে কিছু ভক্তিমূলক গান চালিয়ে দিল টিভিতে।
Dirtyminds.in । কি জানি মনে করে ওয়েবসাইটটা খুলে বসলো সে। অন্যান্য চারপাশটা ওয়েবসাইটের মতই দেখতে। বেশ সুন্দর ডিজাইনের জামা কাপড় বিক্রি করা হচ্ছে এতে। আচমকাই কারেন্ট চলে গেল। ল্যাপটপটাও গেল বন্ধ হয়ে। অনেকদিন ধরে ল্যাপটপটার ব্যাটারি খারাপ হয়ে গেছে। তাই কারেন্ট অফ ফট করে শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায় তার ল্যাপটপ। বাইরে এখনো সো সো করে হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো এবার জোরে। বৃষ্টি আসার ঠিক আগেই এইভাবে কারেন্ট কেটে যায় ।
যদিও বা এটা স্বাভাবিক। তাও হঠাৎ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল সে। ল্যাপটপটা আবার জ্বলে উঠেছে। ল্যাপটপটা এখনো চলছে কি করে। ব্যাটারি কি আবার নিজে নিজে ঠিক হয়ে গেল।
ওয়েবসাইটটা এখনো খোলা।
তাড়াতাড়ি ওয়েবসাইটটা বন্ধ করতে গেলে বিচ্ছিরি শব্দ করে একটা পপআপ দেখা দিল। আজকালকার যুগের এই নতুন টেকনিক। হয়তো কুপন কোড অফার করবে।
না, তার কুপন কোড চাই না। সবুজ বোতাম তার পাশাপাশি একটা বড় আকারের লাল রঙের বোতামও দেখা যাচ্ছে। বেশি কিছু না পড়েই সেটা টিপে দিল অনির্বাণ।
“যত্তসব জ্বালা। আজকালকার ছোকরাগুলো যা পারে তাই লেখে। সাইট টা বন্ধ করতেও কত ঝামেলা।” মনের মধ্যেই কচ কচ করছিল অনির্বাণ।
কিন্তু হঠাৎ তার নজর পড়লো সেই লাল বোতামে। ততক্ষণে টেপা হয়ে গেছে। কিন্তু ওয়েবসাইট টা হ্যাং করে গেছে মনে হয়।
লাল বোতামে আবার গ্রহণ করুন লেখা আছে কেন? আতঙ্কে সে গুগল ক্রোম টাই আনইন্সটল করে দিল ল্যাপটপ থেকে।
হট করে ফোনটা বেজে উঠলো। কই কেউ কল করছে না তো। ফোনে স্ক্রিনটা দপ করে জ্বলে উঠেছে। এখানেও একই ওয়েবসাইট খোলা। বেশি কিছু না ভেবে ফোনের সাইডে বোতামটা ৩ সেকেন্ড টিপে রেখে একদম সুইচ অফ করে দিল।
এই গল্পটা সত্যিই তাকে ভয় খাইয়ে দিয়েছে। হয়তো সেই কখনো এই ওয়েবসাইটটা ফোনে খোলার চেষ্টা করছিল।
4
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আচমকাই তার নজর পড়লো, সামনে রাখা ৬৫ ইঞ্চি বড় টিভির দিকে। এইতো গতবার কালীপূজায় পুরো ক্যাশ টাকায় সে কিনেছে। শারদীয়া ম্যাগাজিন গুলো দারুন বিক্রি হয়। প্রচুর মুনাফা হয়েছিল এ বছর।
একগাদা ছবি চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে টিভির মধ্যে দিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ে। ভয়ে আতঙ্কে এরকম বিকৃত মুখ সে কখনো দেখেনি। অবাক করার বিষয় হলো এদের কারোরই কোন চোখ নেই।
হঠাৎই অনির্বানের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। একগাদা ভূতের গল্প পড়ে এরকম অনেক বার হয়েছে।
ভালো করে নিজেকে একবার চিমটি কেটে দিল সে। না সে জেগেই রয়েছে। তার ওপর কারেন্ট নেই। কিন্তু তাও টিভিটা চলছে কি করে?
সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবিগুলো আর নেই। তার বদলে কুয়াশার মতো ঝাপসা ভাবে ফুটে উঠেছে একটা পুরনো দোকান। ঠিক এক বছর আগে প্যারামাউন্ট শরবতের দোকানের ঠিক উল্টোদিকে অনির্বাণের দোকানের মতো দেখতে লাগছে।
না এটা তো অনির্বাণের দোকান ই বটে।
অনির্বাণ তো নিজেকেও দেখতে পাচ্ছি টিভিতে। তুষারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিন্তু মুখের জায়গাটা ঝাপসা দেখাচ্ছে দুজনেরই ।
! হঠাৎ, তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল।
5
“তুষার!”
অস্ফুটো স্বরে ছাড়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো নামটা। তুষার তার কলেজে জুনিয়র ছিল। পড়াশোনায় প্রচন্ডভাবে মেধাবী , কলেজের শেষে জেট এয়ারওয়েজ কোম্পানিতে ভালো মাইনেতে চাকরি পেয়েছিল। বিয়ে করেছিল শ্যামলীকে। ওর ই ক্লাসমেট। শ্বেতবর্না আসামি মেয়েটাকে অনির্বাণের ভালোভাবেই মনে আছে।
শুধু তাই নয়। কলেজের সবারই মনে থাকবে। কলেজের যে কোন উৎসবে অসাধারণ নাচতে পারতো মেয়েটা। কলেজ পাস করতে না করতেই বিয়ে। সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু করোনার সময়তে কোম্পানিটাই উঠে গেল। মাইনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় ছয় মাস কাজ করার পর অনির্বাণকে এক টাকাও দেয়নি কোম্পানি থেকে।
অনির্বাণ তখন দোকানের জন্য একটা কর্মচারী খুঁজছে। কলেজের হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে “তোদের চেনা সোনার মধ্যে কেউ আছে তো বলিস” লিখে পোস্ট করতেই তুষারের কল এসেছিল। অনির্বাণ তো এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছিল। খুশিমনে তুষারকে কাজটা দিয়েছিল সে। সাধারণের যা বেতন তার অর্ধেক বেতনেই তুষার রাজি হয়ে গেছিল। অনির্বাণও খুশি!
পয়সা বাঁচাবার জন্য একদিন অনির্বাণ তার দোকানের ম্যানেজারকে তাড়িয়ে দিল। তুষার হয়ে গেল তার নতুন ম্যানেজার। শুধু তাই নয়, মাত্র এই চার বছরেই প্রায় কুড়িটা উপন্যাস লিখে ফেলেছে তুষার। কলেজস্ট্রিটের প্রত্যেকটা ম্যাগাজিন তার কাছে অনুরোধ করতে লাগলো লেখা দিতে।
তুষারের আশীর্বাদে অনির্বাণে বিক্রি এখন আকাশছোঁয়া। এতটাই বেশি বিক্রি যে সে দোকানটা বদলে ফেলল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের বড় বড় প্রকাশকদের পাশে বিশাল ভাড়া দিয়ে তার দোকান খুললো। তবে লেখকদের টাকা বা রয়্যালটি দেওয়া একদমই পছন্দ ছিল না তার।
“রিক্স নেবো আমি? বই ছাপাবো আমি! লেখক দেখতে কোন ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেই। তাদের উচিত আমাকে ওদের লেখা ছাপাবার জন্য টাকা দেওয়া। লেখক তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায় আজকাল।” অনির্বানের ঠিক এরাম টাই দাবি ছিল। তুষারের মতো লেখক যখন সে তৈরি করতে পেরেছে, লেখক তৈরি করা তার বাঁ হাতের মোয়ার মত। এর জন্য তাকে কারো ধার ধারতে হবে না। কিন্তু তুষারকে পই পই করে বলে দিয়েছিল সে যখন টাকার দরকার হবে সে চাইলেই পেয়ে যাবে।
তুষারে কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। মাইনে কম হলেও চাকরিহীন মন্দার বাজারে তাকে দু পয়সায় উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছিল অনির্বাণ। তার কৃতজ্ঞতা সে কখনোই ভুলবে না। সে কখনো তার সামান্য বেতনের বাইরে এক পয়সাও চাইত না। শ্যামলীকে নিয়ে এক কামরার মেসঘরে কলেজ স্ট্রিটের পাশেই বেশ সুখে শান্তিতে থাকত সে।
একবার, সন্তানের জন্মের সময়, তুষার অনির্বাণের কাছে ১ লাখ টাকা চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎই সেই দিন থেকে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরের দিন আরও একটা খবর আছে, তুষারের স্ত্রী শ্যামলি নাকি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতালে মারা গেছে।
6
টিভিতে এখন কলেজ স্ট্রিটের দৃশ্য মুছে গেছে।
খানিকটা বিস্ময় আর আতঙ্কের সাথে সে একটা ভয়ংকর ছায়া হাঁটছে… তার নিজের ফ্ল্যাটের দিকে! এইতো নিচে সিকিউরিটি গার্ড ডেকেও সে চিনতে পারছে। কই সিকিউরিটি গার্ডটা এই ছায়াটাকে দেখতে পেল না তো। লিফট চলছে না কারেন্ট নেই বলে। ছায়াটা সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগলো। এ সিঁড়িগুলো চিনতে তার একদমই অসুবিধা হচ্ছিল না। পানির পিক ফেলে ফেলে সে লাল রং করে দিয়েছে চারপাশে। তা মনে হল সেই জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে বসে আছে। এই তো তার ফ্ল্যাটের দরজাটা দেখা যাচ্ছে। সেই কুচকুচে কালো লম্বা শরীরটা ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়লো। এখন সে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে। তার টিভির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকা ছবি নিজেরই টিভির মধ্যে দেখে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।
সে জেগে উঠতে চেয়েছিল। নিজের মনে বারবার প্রার্থনা করছিল অনির্বাণ যেন এটা কোন এক দুঃস্বপ্ন হয়। এইমাত্র সে উঠে বসবে।
কিন্তু … ফ্ল্যাটের দরজা তো বন্ধ ছিল। তাহলে ঢুকলো কিভাবে?
প্রচন্ডভাবে শীত করছে তার। পিছনে ঘোরা শক্তিটাও হারিয়ে গেছিল তার। হঠাৎ মনে হল টিভির উপরই যেন ক্যামেরাটা রাখা। টিভির মধ্যে তার ছবিটা এখন সামনাসামনি থেকে দেখা যাচ্ছে। তার পিছনে সেই ছায়াটা দাঁড়িয়ে। শরীর স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেলও ছায়ার কোন মুখ ছিল না। হঠাৎ যেন ছায়াটা হেসে উঠলো। মুখটা যেন ঠিক মাঝখান থেকে ফেটে গেল। দুই সেট করাতের মত দাঁত উল্লম্বভাবে সারিবদ্ধ, একটা অন্যটার উপরে। ভয়ঙ্কর একটা চেন খোলা হয়েছে যেন!
7
পরের দিন সকালে কাজ করতে এসে অনির্বাণের মৃতদেহ দেখে কাজের মাসি অজ্ঞান হয়ে যায়।
অনির্বাণের চোখ গুলো কেউ যেন নির্মমভাবে উপড়ে ফেলেছিল।
এখন যদি আপনার ওই ওয়েবসাইটে যান তখন ওই চক্ষুহীন সারিবদ্ধ বাচ্চাদের গ্যালারিতে অনির্বাণের স্কুল জীবনের একটা ছবি দেখতে পাবেন। কিন্তু সেই ছবিতে কোন চোখ নেই।
কিন্তু আপনি যদি কোন প্রকাশক হন আর যদি দেখেন যে ওয়েবসাইট টা খুলছে না, তবে তাড়াতাড়ি সাত দিনের মধ্যে লেখকদের পেমেন্ট বা রোয়ালটি দিয়ে দেবেন। না হলে আপনারও ঠাঁই হবে সেই গ্যালারিতে।
Leave a Reply